আড়াই বছর বয়সে শফিকুল ইসলাম (২৫) হারিয়েছেন পিতাকে। চারজনের সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। জীবিকার তাগিদে ১৬ বছর বয়সেই সাগরে নামেন তিনি। ২০০৭ সালে যে সাগরের অতলে হারিয়ে গেলো পিতা আহমদ হোসেন, ২২ বছর পর তার কূলেই দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন ছেলে।
শফিকুল ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম। তাঁকে হারিয়ে শোক-অনিশ্চয়তায় স্ত্রী-সন্তান ও মা। এই শোক কেবল তাদের একার নয়। আরো ছয় পরিবারেও নেমে এসেছে অন্ধকার। এ ঘটনার ১৭ দিন গত হয়েছে। কিন্তু অসহায় পরিবারগুলোর পাশে কেউ নেই। কিছুদিন আগে পৌরসভার পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হলেও কোনো ধরনের খোঁজ নেয়নি ট্রলার মালিক মোহাম্মদ সেলিম, জেলা প্রশাসন কিংবা মৎস্য অধিদপ্তর।
চার বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে শফিকুল সবার ছোট। তার দগ্ধ হওয়ার খবরে ননদ রশিদা বেগমকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন স্ত্রী তসলিমা আক্তার (২১)। তাদের সঙ্গী ছিল ১৩ মাস বয়সী শিশু সুমাইয়া জান্নাত।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দুদিন আইসিউতে ছিল শফিকুল। সেখানে দগ্ধ বাবার যন্ত্রণা সচক্ষে দেখেছে অবুঝ সুমাইয়াও। জায়গা সংকটের কারণে সুমাইয়াকে নিয়ে দু’দিন বাইরে কাটান তসলিমা। গত ৫ সেপ্টেম্বর রাত ১২টার দিকে শফিকুল মারা যান।
এদিকে স্বামীর মৃত্যুর ধকল না কাটতেই তসলিমার জীবনে নেমে আসে আরেক বিপদ। শিশু সুমাইয়ার ধরা পড়ে ডেঙ্গু। গত ৯ দিন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন শিশুটি। শুক্রবার বাড়ি ফিরেছেন। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি।
শফিকুল ইসলামকে হারিয়ে বিপাকে পুরো পরিবার। পরিবারে আহাজারি থামছে না। ছবিটি শনিবার বিকেলে তোলা
শনিবার বিকেলে আকাশসম হতাশা নিয়ে সন্তানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তিনি বললেন, “স্বামী যখন মারা যায় মেয়েটার জ্বর ছিল। সম্বলের অভাবে ডাক্তার দেখাতে পারিনি। প্রথমে ওষুধ খাওয়াই। সাতদিন পর ভালো না হওয়ায় পরীক্ষা দিই, এতে ধরা পড়ে ডেঙ্গু।”
একেই তো স্বামী হারানোর রাজ্য সমান শোক, অন্যদিকে সন্তান বাঁচানোর লড়াই। চিকিৎসা খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়েছে তসলিমার। হাসপাতালে রোজ কিনতে হয়েছে ওষুধ, অক্সিজেন, পাইপ ও গ্যাস। বাড়ি ফিরলেও চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন ভালো খাবার খাওয়াতে।
তসলিমা বলেন, “একটা পরীক্ষা করাতে হয়েছে আট-নয়শ টাকায়। দৈনিক লেগেছে ২-৩ হাজার টাকা। রক্ত শূন্যতা পূরণে ভালো খাবার খাওয়াতে বলেছে ডাক্তার। কাল রাতে খিঁচুনি দেয়, বুকটা ক্ষেপে উঠেছিলো। চিকিৎসা বাবদ ইতিমধ্যে ২০ হাজার টাকা দেনা হয়েছে।”
তসলিমা সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে আছেন অন্ধকারে। বললেন, “আমার ভবিষ্যত তো নেই। বাচ্চাদের জন্য বাঁচতে হবে। একটা চাকরি পেলে গতি হতো।”
ছেলের মৃত্যুর ১৫ দিন আগে আমিনা বেগমের (৫২) বাম পাশের চোখের অপারেশন হয়। এখনো চোখের ক্ষত সেরে উঠেনি । পুত্র শোকে রোজ অশ্রু ঝরছে সেই চোখ বেয়ে।
কাঁদতে কাঁদতে আমিনা বেগম বললেন, “ছেলেটা মারা যাওয়ার দুদিন পর আমার ১৩ মাসের নাতির ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এখন নাতি, পুত্রবধূ এবং নিজে বাঁচতে হলে সকলকে এগিয়ে হবে। না হয় ভিক্ষার থালা হাতে নেয়া ছাড়া উপায় নেই।”
বোন খুরশিদা বেগম বলেন, “ভাইটা সাগরে যেতে চাইতো না। কূলেও কোনো কাজ নেই, বাধ্য হয়ে সাগরে যেতো।”
মো. ওসমানের (২০) বাড়ির লাগোয়া জান্নাতুল ওয়াকিয়ার (১৮) বাপের বাড়ি। সম্পর্কে ওসমান ওয়াকিয়ার ফুফাতো ভাই। মন দেয়া নেয়ার বছর খানেকের মাথায় দু’বছর আগে তাদের পরিণয় ঘটে। বাবা-মাসহ চারজনের সংসার ভালোই চলছিল। ওসমানকে হারিয়ে তাদের জীবনে ভর করেছে অনিশ্চয়তা।
অন্তঃস্বত্তা থাকার ছয় মাসের মাথায় ওসমান-ওয়াকিয়া দম্পত্তির প্রথম সন্তান মারা যান। এখন ওয়াকিয়ার গভে ওসমানের দ্বিতীয় সন্তান। কিন্তু সেই সন্তানের মুখ দেখতে পারলো না ওসমান।
জান্নাতুল ওয়াকিয়া বলেন, “তার (ওসমানের) পুরো অঙ্গটাই পুড়ে শেষ হয়ে গেলো, এখন আমি কষ্টে পুড়ছি। আফসোস লাগছে, অনাগত সন্তানের মুখটা দেখলো না।”
জান্নাতুল ওয়াকিয়া বলেন, “এক সন্তানকে পেটে হারিয়েছে, এখন হারিয়েছি স্বামীকে। আমার অনাগত সন্তানের কি হবে ভেবে পাচ্ছি না।”
ওসমানের মা জোহরা বেগম বলেন, “আল্লাহ আমাকে ধন দিয়ে ধন কেড়ে নিয়েছে।”
বড় কোহিনুর আক্তারও সচক্ষে দেখেছেন দগ্ধ ভাইয়ের আর্তনাদ। বললেন, “ওসমান স্বজ্ঞানে কথা বলতে পারেনি। আহাজারিতে রাতদিন এক ছিল। কত যন্ত্রণাই না পেলো ভাইটা। সামনে তাঁর সন্তানের ডেলিভারি হবে। এই ধকল সামলাবো কিভাবে বুঝে উঠতে পারছি না।” শফিকার তিন সন্তানের কি হবে?
সুলতান আহমদ আর সফুরা বেগমের সংসারে চার মেয়ে। ছেলের অভাব ঘুচাতে একযুগ আগে বড় মেয়ে শফিকা আক্তারের সাথে টেকনাফের দিল মোহাম্মদের (৩৩) বিয়ে দেন। সেই থেকে দিল মোহাম্মদ ঘর জামাই ছিলেন। জীবিকার যোগানে যেতেন সাগরে। সাগর বন্ধ থাকলে করতেন দিনমজুরি।
শফিকার বাবা দু’বছর প্যারালাইসিস আক্রান্ত ছিলেন, আট মাস আগে মারা যান। তাঁর চলে যাওয়ায় পরিবারের দায়িত্ব শফিকার স্বামীর কাঁধেই ছিল। পিতা হারানোর ক্ষত না শুকাতেই চলে গেল স্বামীও।
এই দম্পত্তির বড় মেয়ে ইসমত আরা (৯) তৃতীয় শ্রেণীতে, ৮ বছরের ওমর ফারুক দ্বিতীয় শ্রেণীতে ও ৫ বছরের মোহাম্মদ আরমান নার্সারীতে পড়েন। এই তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকারে শফিকা।
শফিকা আক্তার বলেন, “বাবা মারা গেলো ৮ মাস। নাই একটা বড় ভাই। আমি সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করতে চাই, কিন্তু সামর্থ নেই। ১৬ হাজার টাকার ঋণ রেখে মারা গেলো স্বামী। আথিক অবস্থা খুব খারাপ।”
মৃত্যুর আগের দিন এশারের পর বাড়িতে এসেছিলেন দিল মোহাম্মদ। রাতে ঘুমিয়ে সকাল ৬টায় সন্তানদের ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে ট্রলারে গিয়েছিল তিনি। তাঁর সন্তানেরা ঘুম থেকে উঠেই বাবা দগ্ধ হওয়ার খবর শুনেন। এরপর শফিকা ছুটেন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকা মেডিকেলে।
শফিকা বলেন, “চিকিৎসাধীন অবস্থাটয় স্বামীর হাত-পা বাঁধা ছিল। দৈনিক আটটি ইনজেকশন দেয়া হতো । মৃত্যুর আগে যন্ত্রণায় চিৎকার করেছে। আমি সান্ত্বনা দিতাম। বার বার হাতের বাধ খুলে দিতে অনুরোধ করেছিলো।”
তিনি বলেন, “আমি (দিল মোহাম্মদ) তো শেষ হয়ে গেছি। আমার সন্তানদের দেখে রেখো। আর বলতো, আমি বাঁচবো না। ঋনগুলো শোধ করে দিও।”
শফিকার মা সফুরা বেগম বলেন, “আমাদের আয় করার কেউ নেই। বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ কি হবে? তাদের মানুষ হিসেবে গড়তে দরকার সহযোগিতা।”
আলীর চোখে ২-৩ মিনিটের বিভীষিকা : মোহাম্মদ আলীর (২৩) চার ভাই, তিন বোন। সংসারের বোঝা মাথায় নিয়ে ২০১৬ সালে শুরু হয় তার সাগরযাত্রা। বিস্ফোরণ ঘটা ট্রলারের ১৭ মাঝি-মাল্লাদের একজন তিনি। সেদিনের ঘটে যাওয়া ২-৩ মিনিটের বিভীষিকা এখন নিত্যসঙ্গী।
মোহাম্মদ আলী বলেন, “এ বছর প্রথম তাদের সাথে সাগরে যাই। ঘটনার দিন বাবুচি মাহাদু ও মো. সালাম বাড়িতে ছিলেন। বাকীরা ভোরে ট্রলারে আসে। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সবাই গল্প করছিল। তাদের কোলাহলে আমার ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠে শৌচাগারে যাই। সেখানে ২-৩ মিনিট ছিলাম। এরই মধ্যে বিকট শব্দে ট্রলার কেঁপে উঠলো। আমি শৌচাগার থেকে বেরিয়ে দেখি, কেবিন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো, মানুষগুলো কাতরাচ্ছে।”
সেই বিভীষিকার দৃশ্য মাথায় চেপে বসেছে মোহাম্মদ আলীর। প্রতিমুহুতে আঁতকে উঠছেন। বললেন, “একসাথে এতগুলো মানুষ ছিলাম, হঠাৎ নাই হয়ে গেলো। মুহূর্তটি বার বার চোখে ভাসছে, আর আঁতকে উঠছি। ঘুমাতে পারছি না।”
মোহাম্মদ আলী বলেন, “নিহতদের মধ্যে ওসমান আমার বন্ধু, রহিমুল্লাহ ওসমানের ভাগিনা। আমরা একসাথে থাকতাম। তাদের গায়ের ঘ্রাণ আমার শরীরে লেগে আছে।”
খোঁজ নেয়নি ট্রলার মালিক : গত ১ সেপ্টেম্বর সকালে শহরের বাঁকখালী নদীর ৬ নম্বর ঘাট এলাকায় গ্যাসে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ১২ জেলে দগ্ধ হন। তারা মোহাম্মদ সেলিমের মালিকানাধীন ট্রলারের জেলে। এবং কক্সবাজার পৌর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কুতুবদিয়া পাড়া ও সমিতি পাড়ার বাসিন্দা।
এ ঘটনায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন, ওসমান গণি (২০), শফিকুল ইসলাম (২৮), দিল মোহাম্মদ (৩৩), রহিম উল্লাহ (৩০),আরমান (২২), ভোলার শাহিন আলম (৩৫) ও রহিমুল্লাহ (৪২)। এছাড়া দগ্ধ আইয়ুব আলী (৫৫) ও মনির হোসেনের (২৬) অবস্থাও সংকটাপন্ন।
এদিকে ঘটনার ১৭ দিন পেরিয়ে গেলেও নিহতের পরিবারগুলোর কোনো ধরনের খোঁজ নেয়নি ট্রলার মালিক মোহাম্মদ সেলিম। দেয়নি কোনো সহায়তাও। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজন ও স্থানীয় ১নং ওয়াডের কাউন্সিলর আকতার কামাল।
আকতার কামাল বলেন, “যার ট্রলারে মারা গেছে সেই ট্রলার মালিক এখনো কোনো ধরনের সহায়তা নিহতদের পরিবারকে দেয়নি। তাদের খোঁজখবরও নিচ্ছে না। আইনে আছে- ট্রলারে দায়িত্বরত অবস্থায় কোনো জেলে মারা গেলে তাদের বড় অংকের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।”
আকতার কামাল বলেন, “প্রাথমিকভাবে তাদেরকে কিছু সাহায্য করেছি। আগামীতে আরো বড় আকারে সহায়তা দিতে তাদের কাছ থেকে আবেদন নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন ও মৎস্য অধিদপ্তর এগিয়ে আসতে পারেন।”
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, “আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি। নিহতদের পরিবারকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে।”
Leave a Reply