‘মরণব্যথা দিব তোমার চরণে উপহার।’ এভাবে মৃত্যুর মোকাবিলা করতে ক’জন পারেন, যেভাবে রবীন্দ্রনাথ পেরেছেন? ১৪ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু দিয়ে শুরু। একে একে নতুন বউঠান, স্ত্রী মৃণালিনী, তিন সন্তান হয়ে শেষ বয়সে নাতি নীতীন্দ্রনাথ। পরপর আপনজনের মৃত্যুর আঘাত সয়ে সয়েও অবিচল থেকে বিপুল সৃজন ও কর্মকাণ্ডে ডুবে থাকা তাঁর পক্ষেই সম্ভব। অথচ এই মানুষটিই একদিন চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে।’ ছেলে রথীন্দ্রনাথকে যখন এই চিঠি লিখছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির এক বছরও হয়নি! কেন এমন কথা মনে হয়েছিল তাঁর? কীভাবেই বা সেই নৈরাশ্যকে জয় করেছিলেন তিনি? ওই চিঠিতেই রয়েছে সেই ইঙ্গিত।
ঠিক কী লিখেছিলেন তিনি? ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯১৪। পুত্র রথীন্দ্রনাথকে ৫৩ বছরের রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে। মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে না, আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ; —অন্যদের সকলের সম্বন্ধেই নৈরাশ্য এবং অনাস্থা।’ পড়তে পড়তে অবাক লাগে। বিশ্বের মঞ্চে এত বড় সম্মান, তারপরও তাঁর মনে হয়েছে তাঁর দ্বারা ‘কিছুই হয়নি’! এটা যে আসলে তীব্র বিষাদের দংশন থেকে আসছে তা বোঝাই যায়। যিনি বিপুল খ্যাতিমান, তিনিও ভুগতেই পারেন নৈরাশ্যে, বিষাদে। এমন উদাহরণ তো কম নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ, যিনি কম বয়সে ভানুসিংহের ছদ্মনামে ‘মরণ’ কবিতায় লিখতে পেরেছিলেন ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান’, তিনি এভাবে হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো কথা লিখেছেন! এ যেন অবিশ্বাস্য।
কিন্তু সত্য়িই কি অবিশ্বাস্য? আমরা তাঁকে ‘ঠাকুর’ বানিয়েছি। ভুলে গেছি তিনিও শেষপর্যন্ত একজন রক্তমাংসের মানুষই। বারেবারে আঘাতের কষাঘাতে ক্ষয়ে গিয়েছেন। শোকের কালো ছায়ায় ঢাকা পড়েছেন। কিন্তু তারপরও গ্রহণের কবল থেকে বেরিয়ে এসেছেন পূর্ণজ্যোতি নিয়ে। যে জ্যোতি আজও বহু মানুষকে বিপদের দিনে, হতাশার মুহূর্তে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। জুগিয়ে যাবে, যতদিন সভ্যতা থাকবে ততদিন।
অথচ কাজটা কতটা কঠিন ছিল! ভাই বুধেন্দ্রনাথ যখন মারা যান, সেই সময় কবি একেবারেই শিশু। তাই চেতনায় তেমন আঁচড় কাটতে পারেনি সেই মৃত্যু। সেই হিসেবে চোদ্দো বছর বয়সে এক রাত্রে যখন বাড়ির এক পুরনো দাসীর আর্তনাদে কিশোর রবির ঘুম ভাঙল, সেই মুহূর্তেই তিনি প্রবেশ করলেন মৃত্যুর নিষ্ঠুর জগতে। প্রায়ান্ধাকার সেই কক্ষে কেউ তাঁকে কিছু না বললেও রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা হয়েছে। পরদিন সকালে জানতে পারলেন, আশঙ্কাই সঠিক। জীবনস্মৃতিতে তিনি লিখেছেন, পরের দিন সকালে মায়ের মৃত্যুর কথা জানার পর তাঁর কী মনে হয়েছিল- ‘‘এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘর করনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।’’
সেই শুরু। কমবয়সি ভানুসিংহ তবুও মৃত্যুকে ‘শ্যামসমান’ই ভাবতে পেরেছিলেন। এরপর নতুন বউঠানের আকস্মিক প্রয়াণ। কাদম্বরী যখন ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করেন তখন তাঁর বয়স ৯। রবীন্দ্রনাথ ৭। সেই বয়স থেকেই একে অপরের সাথী হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। ১৮৮৪ সালে আত্মহত্যা করেন কাদম্বরী। অনেক পরে ১৯১২ সালে প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখলেন ‘‘চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়।’’
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘লিপিকা’র ‘প্রথম শোক’ কবিতায় ফিরে এলেন কাদম্বরী। ‘আমি ফিরে তার মুখের দিকে তাকালেম। বললেম, ‘মনে পড়ছে, কিন্তু ঠিক নাম করতে পারছি নে।’/ সে বললে, ‘আমি তোমার সেই অনেক কালের, সেই পঁচিশ বছর বয়সের শোক।” কবিতাটির একেবারে শেষে রয়েছে ‘আমি তার হাতখানি আমার হাতে তুলে নিয়ে বললেম, ‘এ কী তোমার অপরূপ মূর্তি।’/ সে বললে, ‘যা ছিল শোক, আজ তাই হয়েছে শান্তি।” এইভাবেই পুরনো হতে থাকা শোককে শান্তিতে পর্যবসিত করে এগিয়ে চলার শক্তিতে ভরপুর হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। নিজেকে বুঝিয়েছেন, ‘কাঁদায় কি ফল তবে, কাঁদিলে ফেরে না যদি কেহ।’
মৃত্যুর সঙ্গে ‘স্থায়ী’ পরিচয়ের পর একসময় কবি হারালেন তাঁর স্ত্রী ‘ছুটি’কে। সেটা ১৯০২ সাল। পরের বছর প্রথমবারের জন্য সন্তানহারা হলেন রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যু হল কন্যা রেণুকার। ১৯০৫ সালে বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রয়াণ। ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ সন্তান শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু। ১৯১৮ সালে কন্যা মাধুরীলতা। পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনজনই চলে গেলেন তাঁকে ছেড়ে। অন্যদিকে ছোট মেয়ে মীরার ‘ভুল’ বিয়ে দেওয়ার আপশোসও তাঁকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। জামাই নগেনের ‘দুর্দ্দাম বর্ব্বরতা’-য় মেয়ের দুর্দশা নিজের চোখে দেখতে পারছিলেন না কবি। ৭০ বছর বয়সে মীরার ছেলে ২১ বছরের নীতীন্দ্রনাথের মৃত্যুও দেখতে হল তাঁকে। এরই পাশাপাশি রয়েছে আরও অসংখ্য প্রিয়জনদের প্রস্থান। কিন্তু নুয়ে পড়তে পড়তেও উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি। শোক ও অভিমানে ক্ষয়ে গিয়েও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন পূর্ণ শক্তি নিয়ে। ‘যক্ষপুরী’ নামের নাটককে ‘রক্তকরবী’ করে তুলতে অন্তত দশবার লিখেছেন। এই একটি উদাহরণই বলে দেয় বারবার সংশোধন কিংবা কাটাকুটির মধ্যে দিয়ে নিজের লেখাকে নিখুঁত করে তুলতে কী পরিমাণ শক্তিক্ষয় করতে হয়েছে তাঁকে। শিল্পীর চির অতৃপ্ত মন নিয়ে মৃত্যুশয্যাতেও কবিতার সংশোধন করে গিয়েছেন। এই পজিটিভ মানসিকতার সঙ্গে সেদিন রথীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিটা নিতান্তই ব্যতিক্রম বলে মনে হয়।
যতগুলি মৃত্যুর বিষতিরে বিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি, তার মধ্যে অন্যতম তিরটি ছিল শমীর মৃত্যু। মাত্র ১১ বছর বয়সেই চলে গিয়েছিল শমীন্দ্রনাথ। কনিষ্ঠ সন্তানের শৈশবে যেন নিজের ছেলেবেলাকেই প্রতিফলিত হতে দেখতেন রবীন্দ্রনাথ। ছোটবেলা থেকেই রুগ্ন শমীর অকালপ্রয়াণে স্তব্ধবাক হয়ে যাওয়া কবি কিন্তু নিজেকে শেষ পর্যন্ত জীবনে ফেরাতে পেরেছিলেন। ছোট মেয়ে মীরাকে লিখেছিলেন, ‘শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্চে, কোথাও কিছু কম পড়েচে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি— সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে।’
কিন্তু এমন মানুষও যে একটানা আঘাত সইতে সইতে জীবনের কোনও বাঁকে ক্ষণিকের জন্য আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন, তা বুঝিয়ে দেয় শেষপর্যন্ত তিনি দেবতা নন। মানুষই। কিন্তু এমন এক ‘জীবনের চেয়ে বড়’ মানুষ, যাঁর হৃদয়ে রয়েছে অপরিসীম শক্তি। যে বিপুল শক্তি তাঁকে ঘন বিষণ্ণতার কবল থেকে সরিয়ে আনতেও পেরেছিল। রথীন্দ্রনাথকে লেখা সেই চিঠিতেই প্রৌঢ় মানুষটি লিখেছিলেন, “…কিছুদিন সুরুলের ছাতে শান্ত হয়ে বসে আবার আমার চিরন্তন স্বভাবকে ফিরে পাব সন্দেহ নেই– মৃত্যুর যে গুহার দিকে নেবে যাচ্ছিলুম তার থেকে আবার আলোকে উঠে আসব কোনো সন্দেহ নেই।”
‘চিঠিপত্র’র দ্বিতীয় খণ্ডেই রয়েছে এই চিঠি। ইউনানি ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে সেই সময় এক ধরনের তীব্র মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘মেটিরিয়া মেডিকা’ পড়ে নিজেই সেই সব উপসর্গকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন। একদিকে মৃত্যুর কালো গহ্বর তাঁকে টানছে, অন্যদিকে একই সঙ্গে সদর্থক এক হৃদয় নিয়ে তিনি ‘আলোকে উঠে আসব’ বলে পণ করছেন। পরবর্তী সময়ে বন্ধু সি এফ অ্যান্ড্রুজকে লেখা চিঠিতেও এই ধরনের অবসাদের কথা আছে। এবং সেবারও শেষ পর্যন্ত আলোর দিকেই পাশ ফিরেছেন তিনি। বুঝতে পেরেছেন, ‘মৃত্যু যাঁর ছায়া অমৃতও তাঁরই ছায়া।’ এই বোধ, এই দর্শনই তাঁকে উত্তরণের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পরের বছরগুলিতে। যে যাত্রাপথ যে কোনও বিষণ্ণ, জীবন থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা মানুষের পাথেয় হতে পারে। আজও। আগামিদিনও।
Leave a Reply