কিশোরগঞ্জের দূর্গম হাওরে জন্ম নিয়ে কাঁদা মাটিতে বেড়ে ওঠা মো.আবদুল হামিদ দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দুই মেয়াদ শেষ করে রাজসিক বিদায় নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। দেশের সর্বোচ্চ এ পদে দুই মেয়াদ থেকে শান্তিপুর্ণ প্রত্যাবর্তন এই প্রথম। সোমবার (২৪ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১১ টায় তিনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। মো. আবদুল হামিদ অবসরে যাওয়ায় কিশোরগঞ্জের নানান শ্রেণীর মানুষ বেদনা অনুভব করছেন। এছাড়া আবদুল হামিদ রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণায় কিশোরগঞ্জে হতাশা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।
জেলার দুর্গম হাওর উপজেলা মিঠামইনের কামালপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া আবদুল হামিদ হাওরের কাঁদা জলে বড় হয়েছেন। হাওরের রাখালদের সাথে সখ্যতা, নৌকায় চড়া ও প্রকৃতির সাথে ছিল তাঁর মিতালী। গুরুদয়াল কলেজে অধ্যায়নকালে ১৯৫৯ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগদান করেন। তিনি গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ও ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬১ সালে আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় আবদুল হামিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৪ সালে তিনি তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে ছাত্রলীগকে তৃণমূলে শক্তিশালী করতে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৮ সালে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃতৃ¦ দেয়ায় পাকিস্থান সরকার আবারো আবদুল হামিদকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। জেল থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৬৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৮ (ইটান, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী ও তাড়াইল) আসনে পাকিস্থান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭২ সালে গণপরিষদ সদস্য, ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৯ সালের নির্বাচনসহ মোট সাতবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ভাটির শার্দুল বলে খ্যাত মো. আবদুল হামিদ। হয়েছেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার, বিরোধী দলীয় উপনেতা, স্পীকার, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও দুইবার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। যা একজন রাজনীতিবিদের পাওয়া অনেকের চেয়ে বেশী।
১৯৭৪ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়েও আওয়ামী লীগের সভা সমাবেশ করেছেন। জেলার এমন কোনো গ্রাম ও ইউনিয়ন নেই যেখানে আবদুল হামিদের পদচারনা নেই। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে শুরু করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালীন অবস্থায় পুরো জেলায় তিনি কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে দলীয় নেতাকর্মীদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে এনেছেন। দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের আহবানে তিনি দ্রুত সাড়া দিয়েছেন। সেই মাটি ও মানুষের নেতা মো. আবদুল হামিদ রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ায় দলীয় নেতাকর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। তবে রাজনীতি থেকে বিদায় নিলেও কিশোরগঞ্জের একজন অভিভাবক হিসেবে তিনি মানুষের পাশেই থাকবেন বলে অনেকেই আশা প্রকাশ করেছেন।
কিশোরগঞ্জ জেলা গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন বলেন, ‘বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ছাত্রলীগের নেতা আর আমি ছাত্র ইউনিয়নের নেতা থাকাবস্থায় আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে পাকিস্থানী সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছি। বার বার কারাকারে গেলেও তিনি বঙ্গবন্ধুর আর্দশের সাথে বেঈমানী করেননি। ১৯৯৩ সালে তিনি ( মো. আবদুল হামিদ) জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। আইনজীবীদের সাথে তিনি দলীয় ভাবনার উর্ধ্বে থেকে সকলের সাথে মিলেমিশে কাজ করেছে। তিনি একজন সফল ব্যক্তিত্ব। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা না হয়েও তিনি দুই বার রাষ্ট্রপতিসহ দেশের বিভিন্ন দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেছেন। তিনি আমাদের মাঝে আছেন এবং থাকবেন।’
কিশোরগঞ্জ জেলা সামজিক আন্দোলনের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট অশোক সরকার বলেন, ‘বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আমাদের অহংকার ও আমাদের গর্ব এবং আমাদের অভিভাবক। আজকের দিনটি সত্যি বেদনার। আবদুল হামিদ ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর সৈনিক ছিলেন। কারাবন্দি হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আর্দশচ্যুত হননি। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায় এলাকার সাধারণ মানুষকে বঙ্গভবনে ডেকে কথা বলেছেন। প্রতি মাসেই কিশোরগঞ্জের মানুষের খবর নিয়েছেন। তিনি জনতার, তিনি জনতার কাতারে আমৃত্য থাকবেন বলে আমি প্রত্যাশা করি।’
তাড়াইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা মোতাহার হোসেন আজিজ বলেন, ‘১৯৬৪ সালে আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জ মহকুমা জেলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি থাকাকালীন সময়ে কিশোরগঞ্জ শহর থেকে দাঁড় বাওয়া নৌকাযোগে তাড়াইল বাজারে আসেন। এরপর কয়েক মাইল পথ পায়ে হেঁটে তিনি জাওয়ার বাজারে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সম্মেলন করেন। আমি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম। একজন জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা থাকলেও তিনি ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়ে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছেন। পাকিস্থানী স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে শহরের বড় বড় ছাত্রজনতার মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন আজকের বিদায় প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ। তিনি আমাদের মাঝে আছেন। আগের মতো প্রটোকল থাকবে না। সাধারণ মানুষ আরো বেশী যোগাযোগ করতে পারবে বলে আমি মনে করি।’
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) বীরমুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘মো.আবদুল হামিদকে নিয়ে আমরা এক সাথে ছাত্ররাজনীতি করেছি। পাকিস্থান সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে শহরে বড় বড় মিছিল মিটিং করেছি। গ্রামে গ্রামে গিয়ে দলকে শক্তিশালী করেছি। ৭৫’ এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মো. আবদুল হামিদকে বন্দি করা হয়। এরপর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে আমার মাধ্যমে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, আবদুল হামিদ বিএনপিতে যোগ দিলে তাকে মুক্ত করে মন্ত্রী বানানো হবে। কিন্তু আবদুল হামিদ মন্ত্রীত্ব প্রত্যাখান করে কারাগারকেই বেছে নিয়েছিলেন বলে। সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে মাটি ও মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও আমাদের অভিভাবক হিসেবে আমৃত্যৃ থাকবেন।’
Leave a Reply