1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : Editor :
ত্বকী হত্যা:/ বিচারের অপেক্ষায় দশক পার - বাংলা টাইমস
রবিবার, ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০৩:৫২ অপরাহ্ন

ত্বকী হত্যা:/ বিচারের অপেক্ষায় দশক পার

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
  • প্রকাশের সময় : রবিবার, ৫ মার্চ, ২০২৩
  • ৪১ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে

নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকান্ড আলোচিত একটি ঘটনা। ২০১৩ সালের ৮ মার্চ শহরের পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খাল থেকে ত্বকীর মরদেহ উদ্ধারের পর সারাদেশে বিচারের জোরালো দাবি ওঠে। কিন্তু এক দশকেও এই হত্যা মামলাটি বিচারের জন্য আদালতে ওঠেনি। দীর্ঘ এই সময়ে মামলাটির অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব। এক দশক পরেও র‌্যাব বলছে, তদন্ত চলছে। এই তদন্ত কবে নাগাদ শেষ হবে তাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

 

 

এদিকে এই মামলায় গ্রেপ্তার আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এখন দেশে ও দেশের বাইরে পলাতক। ত্বকীর পরিবার ও সুধীমহলের অভিযোগ, নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবার এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত বলে তদন্ত শেষ হওয়ার পরও অভিযোগপত্র না দিয়ে কালক্ষেপন করা হচ্ছে। দীর্ঘসময়েও এই হত্যাকান্ডের বিচার শুরু না হওয়াকে তারা ‘বিচারহীনতার’ সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন।

শহরের শায়েস্তা খাঁ সড়কের বাসায় পরিবারের সাথে থাকতেন তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। অত্যন্ত মেধাবী এই তরুণ এ লেভেল পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞানে (২৯৭/৩০০) সারাবিশ্বে সর্বোচ্চ এবং রসায়নে (২৯৪/৩০০) বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পান। তবে এই ফলাফল দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। ২০১৩ সালে পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেরদিন ৬ মার্চ বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন। দুইদিন পর ৮ মার্চ সকালে শহরের পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খাল (কুমুদিনী খাল) থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয়।

গত বৃহস্পতিবার যে ঘরটিতে ত্বকী থাকতেন ওই ঘরেই কথা হয় তার পিতা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির সাথে। ওই ঘরের দেয়ালে ঝুলছে ত্বকীর একটি ফটোফ্রেম। সন্তানের স্মৃতি ধরে রাখতে ঘরটির তেমন পরিবর্তন করা হয়নি। ত্বকীর ব্যবহৃত পড়ার টেবিল, বসার চেয়ারটিও আগে যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। মনের খেয়াল লিপিবদ্ধ করা খেরোখাতাটিও রাখা হয়েছে সযত্নে।

পিতা রফিউর রাব্বি বলেন, “ঘটনার দিন বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে শহরের সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে চাষাঢ়ায় আমার অফিসে আসার কথা। কিন্তু সে আর আসেনি। অনেক খোঁজাখুজি করেও তাকে না পেয়ে সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়।”

ত্বকী হত্যা মামলার নথিসূত্রে জানা যায়, নিখোঁজের দুইদিন পর ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার হয়। ওইদিন অজ্ঞাত আসামি করে সদর মডেল থানায় মামলা করেন রফিউর রাব্বি। পরে ১৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমান, জেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা জহিরুল ইসলাম পারভেজ ওরফে ক্যাঙারু পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমানকে ত্বকী হত্যার সাথে জড়িত উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে একটি অবগতিপত্র দেন রফিউর রাব্বি।

তিনি অভিযোগ করেন, শামীম ওসমানের নির্দেশে তার ছেলে অয়ন ওসমান ও ভাতিজা ওসমানসহ অন্যান্য সহযোগিরা মিলে ত্বকীকে আজমেরী ওসমানের ‘টর্চার সেল’ উইনার ফ্যাশনে নির্যাতন করে হত্যা করে মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে।

শুরুতে থানা পুলিশ মামলাটির তদন্ত করলেও ওই বছরের ২০ জুন হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব)। এরপর ৭ আগস্ট শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে অবস্থিত উইনার ফ্যাশনে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখান থেকে রক্তমাখা জিন্স প্যান্ট, পিস্তলের বাট, ইয়াবার সরঞ্জাম উদ্ধারের কথা জানায় র‌্যাব। ওই সময় উদ্ধার হওয়া রক্তমাখা জিন্স প্যান্টটি তরুণ আশিকুল ইসলামের বলে দাবি করেছিলেন রফিউর রাব্বি। আশিক তার চাচাতো বোনের ছেলে। ২০১১ সালের ১১ মে সন্ধ্যায় নিখোঁজ হওয়ার দু’দিন পর শীতলক্ষ্যা থেকে মেলে আশিকের অর্ধনগ্ন মরদেহ। আশিকের মৃত্যুর পেছনেও আজমেরী ওসমান ও তার সহযোগীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছিল।

আশিক হত্যার দুই বছরের মাথায় ত্বকী হত্যার শিকার হয়। ত্বকী হত্যা মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে ইউসুফ হোসেন লিটন ও সুলতান শওকত ভ্রমর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে তারা এই হত্যাকান্ডে নিজেদের জড়িত থাকার পাশাপাশি আজমেরী ওসমানসহ অন্যদের নামও প্রকাশ করেন।

অভিযুক্ত আজমেরী ওসমানের পিতা প্রয়াত একেএম নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টি থেকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন এবং দুই চাচা একেএম শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং একেএম সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও বিকেএমইএ’র সভাপতি।

রফিউর রাব্বি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে র‌্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্ণেল জিয়াউল আহসান বলেন, আজমেরী ওসমানের পরিকল্পনা, নির্দেশ ও সক্রিয় অংশগ্রহণে ত্বকীকে অপহরণের পর নির্যাতনে হত্যা করা হয়। এগারোজন এই কিলিং মিশনে অংশ নেয়। সংবাদ সম্মেলনে সংবাদিকদের একটি ‘খসড়া অভিযোগপত্র’ সরবরাহ করে তদন্তকারী সংস্থাটি। সেখানে হত্যার কারণ ও জড়িতদের বিষয় সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়।

র‌্যাবের সরবরাহ করা ১৪ পৃষ্ঠার ওই অভিযোগপত্রে, পিতা রফিউর রাব্বিকে শায়েস্তা করার জন্য ছেলে ত্বকীকে হত্যা করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়, ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী একেএম শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্ব›দ্বীতা করেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ওই সময় আইভীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন রফিউর রাব্বি। নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যান শামীম ওসমান। এছাড়া ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনের মালিকেরা ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন। রফিউর রাব্বি এই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। স্থানীয় ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও সোচ্চার ছিলেন রফিউর রাব্বি। এসব কারণেই বাবার প্রতি ক্ষুব্দ হয়ে তাকে শায়েস্তা করতে ছেলেকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। ত্বকী হত্যাকান্ডের প্রথম বর্ষপূর্তিতে র‌্যাবের উর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা গণমাধ্যমে এসব তথ্য তুলে ধরেন। যা ওই সময় সকল গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়।

ওই সময় র‌্যাব আরও জানায়, আজমেরী ওসমানের নির্দেশে এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সহযোগীদের নিয়ে ত্বকীকে হত্যা করা হয়। পরে লাশ ফেলা হয় শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খালে। অচিরেই এই হত্যাকান্ডের অভিযোগপত্র দাখিল করার কথা জানালেও দীর্ঘ ৯ বছরেও তা সম্ভব হয়নি।

এদিকে গ্রেপ্তার আসামিরাও জামিনে বেরিয়ে এসে এখন পলাতক। সর্বশেষ এই মামলায় কারাগারে থাকা সুলতান শওকত ভ্রমরও জামিন পেয়েছে। গত বছর মার্চে ত্বকী হত্যাকান্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় নারায়ণগঞ্জের একটি পত্রিকা অফিসে হামলাও চালায় আজমেরী ওসমানের অনুসারীরা।

ত্বকী হত্যা মামলার বাদীপক্ষের আইজনীবী প্রদীপ ঘোষ বাবু বলেন, “তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব দেশের সকল গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে সংবাদ সম্মেলনে কে, কেন, কীভাবে ত্বকীকে হত্যা করেছে বিস্তারিত জানিয়েছে। এই মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আজমেরী ওসমানসহ একাধিক ব্যক্তির এই হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িতের কথা বলেছে। এই হত্যা মামলার সবকিছুই স্পষ্ট। কিন্তু তারপরও র‌্যাব অভিযোগপত্র আদালতে দিচ্ছে না।”

“এখন পর্যন্ত এই মামলায় ৬০ বার তারিখ ধার্য হয়েছে। ৬১তম তারিখ পড়েছে আগামী ১৪ মার্চ। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসা আসামিদের গ্রেপ্তারসহ অভিযোগপত্র দ্রæত দাখিলের বিষয়ে আদালতে আমাদের বক্তব্য একাধিকবার পেশ করেছি। আদালত অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য তাগিদও দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।”

‘হত্যার কারণ স্পষ্ট ও আসামিরা চিহ্নিত’ হওয়ার পরও অভিযোগপত্র দাখিল না করায় বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেন বাদীপক্ষের এই আইনজীবী। তিনি বলেন, “র‌্যাব আদালতে অভিযোগপত্র দেয়ও না, আবার তাগিদ পাওয়ার পরও কবে নাগাদ দেবেন তাও জানান না। রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তা-ব্যক্তিরা এগিয়ে না আসলে বিচার পাওয়ার যে সাংবিধানিক অধিকার তা থেকে বঞ্চিত হতে হবে।”

মামলাটির বর্তমান তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল তানভীর মাহমুদ পাশা বলেন, “মামলাটি একটু জটিল। তাছাড়া বদলিজনিত কারণে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয়েছে। মামলাটির তদন্ত এখনও চলমান আছে। তবে কবে তদন্ত শেষ হবে তা বলতে পারছি না।”

হত্যাকান্ডের এক বছরের মাথায় সংবাদ সম্মেলনে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়ার আশ্বাস প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, “ওই সময় কে কী বলেছে তা আমি ঠিক বলতে পারবো না। কারণ ওই সময় আমি ছিলাম না।”

নিহত ত্বকীর পিতা রফিউর রাব্বি বলেন, সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের নির্দেশে তার ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমানসহ তাদের সহযোগীরা মিলে ত্বকীকে হত্যা করে শীতলক্ষ্যায় ফেলেছে। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব সবই জানিয়েছিল। দ্রুতই তারা চার্জশিট দেবেন বলেও জানিয়েছিলেন।

ত্বকী হত্যার বিষয়ে মন্তব্যের জন্য নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের মুঠোফোনের নম্বরে একাধিবার কল এবং খুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে আজমেরী ওসমানের মা জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পারভীন ওসমান বলেন, “এত পুরোনো জিনিসটা নিয়ে প্রতিনিয়ত ঘাটাঘাটি হয়। ত্বকীর কথা আসলেই আমার পরিবার নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। এইটা নিয়ে আমরা কখনও কথা বলিনি, বলারই বা কী আছে? সত্য একদিন উদঘাটিত হবেই। আমি সহস্রবার বলবো, এইটার সাথে আমার ছেলে জড়িত না। আমরাও চাই, ত্বকী হত্যার বিচার হোক, সত্যটা উদঘাটিত হোক।”

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published.

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায় সিসা হোস্ট