মো. আব্দুল বারী। ঢাকা কর সার্কেল-৩৮, কর অঞ্চল-২ এর কর পরিদর্শক। দুই হাতে টাকা কামান তিনি। করেন বিলাসবহুল জীবনযাপন। রাজস্ব কর্মকর্তা পরিচয়ে দাপটের সাথে চলাফেরা করছেন। কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। নামে-বেনামে রয়েছে বিপুল অর্থ-সম্পদ।
জানা যায়, কর পরিদর্শক আব্দুল বারীর এক সময় টানাটানির মধ্যে সংসার চলতো। ভাগ্য বদল হয় কর পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে। পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ। এখন তিনি অগাধ অর্থ-সম্পদের মালিক। ঢাকায় রয়েছে তিনটি বহুতল ভবন। যার আনুমানিক মূল্য ৪০ কোটি টাকা। এছাড়াও গ্রামের বাড়িতে রয়েছে নামে-বিনামে বিপুল পরিমান সম্পত্তি।
এলাকার এক বাসিন্দা জানান, আব্দুল বারী এক সময় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন। খুব কষ্ট করে চলত পরিবার। এমনকি সময়মতো বাড়িভাড়াও দিতে পারত না। হঠাৎ কী করে তিনি একাধিক বাড়ি ও এত টাকার মালিক হলেন তা আমার বোধগম্য নয়।
কর পরিদর্শক আব্দুল বারীর বিরুদ্ধে অফিস স্টাফদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান করবে দুদক। দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধান করা হবে। নামে-বেনামে থাকা অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, শামীম রেজা নামে এক শিল্পতি ৪টি আয়কর ফাইলে (নিজের, স্ত্রীর ও দুই মেয়ের) সম্পদ বাড়িয়ে দেখানোর জন্য শাহাদাত হোসেন কাজল নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে ৬০ লাখ টাকার চুক্তি করেন। সে মোতাবেক ১১ দফায় ৬০ লাখ টাকা পরিশোধও করেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে কাজল রিটার্ন সংশোধনের জন্য কর অঞ্চল-২-এর কর পরিদর্শক আব্দুল বারীর সঙ্গে ৩৫ লাখ টাকার চুক্তি করেন। লিখিতভাবে টাকা গ্রহণের দায় স্বীকারও করেন বারী। চুক্তি মোতাবেক কাজল বারীকে শিল্পপতির আগের রিটার্নের কপি সরবরাহ করেন। এরপর ফাইল চুরির মূল কাজ শুরু হয়।
ফাইল চুরির মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় কর অঞ্চল-১৪-এর নিরাপত্তা প্রহরী সৈয়দ শাকিল হোসেনকে। এজন্য কর পরিদর্শক বারী শাকিলকে ১৩ লাখ টাকা দেন। এ টাকা থেকে ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা কর অঞ্চল-১-এর নিরাপত্তা প্রহরী নজরুল ইসলামকে দেন শাকিল। নজরুল, সার্কেলের অফিস সহকারী সেলিম শরীফকে ফাইল সরবরাহের জন্য ৩ লাখ টাকা দেন। সেলিম ফাইল দুটি খুঁজে বের করে একজন নোটিশ সার্ভারের মাধ্যমে শাকিলের কাছে পাঠিয়ে দেন। শাকিল ফাইলটি কর পরিদর্শক বারীর কাছে পৌঁছে দেন। বারী শিল্পপতির চাহিদা মোতাবেক নতুন রিটার্ন বানিয়ে নিট সম্পদ বাড়িয়ে দেখান। এরপর নতুন রিটার্নের কপি নজরুলকে দেওয়া হয়। নজরুল সেই ফাইল সার্কেলের আগের স্থানে রেখে দেন।
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি পুরস্কারের জন্য শামীম রেজার আয়করের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এনবিআরকে চিঠি দেয়। সেই চিঠির আলোকে রিপোর্ট প্রস্তুত করার জন্য সার্কেল অফিসার ফাইল তলব করে দেখতে পান, রিটার্নের সম্পদবিবরণীতে তার জাল স্বাক্ষর এবং অন্য সার্কেলের সিলমোহর দেওয়া। এরপর রেজিস্টার যাচাই করে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল।
প্রাথমিক তদন্তের অংশ হিসাবে সার্কেল অফিসার শিল্পপতির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, শাহাদাত হোসেন কাজল তার ও তার পরিবারের অপর সদস্যদের আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে থাকেন। কিন্তু কাজলের আইটিপি সনদ না থাকায় সন্দেহ ঘনীভূত হয়। এরপর কাজলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কাজল জানান, শিল্পপতি ৪টি আয়কর নথিতে সম্পদ বৃদ্ধি করার জন্য মোট ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন। এ টাকা কিস্তিতে গ্রহণ করেন কর পরিদর্শক আবদুল বারী।
এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় কর অঞ্চল-১-এর অফিস সহকারী সেলিম শরীফ ও নৈশ প্রহরী নজরুল ইসলামকে গত ২৭ এপ্রিল সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। কর অঞ্চল-১৪-এর নিরাপত্তা প্রহরী সৈয়দ শাকিল হোসেনকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আর কর পরিদর্শক আবদুল বারীর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) কার্যক্রম চলমান আছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে কর পরিদর্শক আব্দুল বারীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
Leave a Reply