বহুল আলোচিত সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যাকান্ডের ঘটনার পাঁচ বছর ৪ মাস ২১ দিন অতিক্রম হলেও প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি কিংবা সাক্ষ্যগ্রহণ করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
এর আগে মহানগর ডিবি পুলিশ মামলাটি তদন্ত করেও থেমে যায়। পরে মামলাটির তদন্ত করতে গিয়ে বেশ জটিলতায় মুখে তদন্ত সংস্থা পিবিআইকে। ক্লুলেস ও চ্যালেঞ্জিংসহ বিভিন্ন মামলার জট খুলে দেশজুড়ে প্রশংসিত হওয়া এই সংস্থাটির কাছে মিতু হত্যা মামলা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ স্বয়ং ঘটনার বিভিন্ন মোড় ঘুরে পুলিশের সাবেক এসপি বাবুল আক্তার নিজেই পিবিআইয়ের চোখে প্রধান অভিযুক্ত।
ওদিকে অন্ধকারে রয়েছে, যে সুইডিশ নারী গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে বাবুল আক্তার স্ত্রী মিতুকে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে পিবিআই দাবি করে আসছে, সেই গায়ত্রীর খোঁজ মেলেনি আজও। একই সঙ্গে কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেওয়া কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসাসহ এ মামলার একাধিক আসামিই এখনো পলাতক।
শুধু তাই নয়, ঘটনার পর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণের বিষয়ে আদালতের কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, প্রধান প্রত্যক্ষদর্শী তাদের সন্তান আখতার মাহমুদ মাহির। আবার নতুন মামলা হওয়ার আগে বাবুল কেন চাকরিচ্যুত হলেন? এর রহস্য কী ছিল? অনেক অপরাধী বিদেশে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। সেক্ষেত্রে বাবুল কেন কৌশলী হননি? এ ধরনের নানা কথা বাতাসে ভেসে রয়েছে। কিন্তু মামলার নিয়ম হলো সাক্ষী প্রমাণ আর তথ্য উপাত্ত। পিবিআই যা ভেদ করার চেষ্টা করছেন।
এসব কারণে কয়েকজন সাক্ষীর তথ্যের ভিত্তিতে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনকে দিয়ে পাঁচলাইশ থানায় ‘পিবিআইয়ের করানো’ দ্বিতীয় মামলার সমীকরণ এখনো পুরোপুরি মেলাতে পারেনি সংস্থাটি। একটি ঘটনায় দায়ের হওয়া প্রথম মামলা আদালতে চ‚ড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই আরেক মামলা নিয়ে পিবিআইয়ের ‘ছোটাছুটি’।
দুটি বইয়ের একাধিক পৃষ্ঠায় গায়ত্রী ও বাবুল আক্তারের ‘প্রেমালাপ’ লেখা হয়েছিল বলে মিতুর বাবার করা মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে হাতের লেখাগুলো গায়ত্রী কিংবা বাবুল আক্তারের কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায় পিবিআই। সেজন্য চলছে নানা প্রচেষ্টা।
গায়ত্রী অমর সিং যেহেতু জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) কক্সবাজার কার্যালয়ে চাকরি করতেন, সেহেতু এ সংস্থায় তার লেখা নথি চেয়ে চিঠি দেয় পিবিআই। কিন্তু পিবিআইয়ের দেওয়া সেই চিঠির এখনো সদুত্তর দেয়নি ইউএনএইচসিআর। গায়ত্রী-বাবুলের আগের লেখা পাওয়ার পর সেগুলো মিলিয়ে দেখার জন্য সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে, প্রথম মামলায় পিবিআই কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমার চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর আদালত সন্তুষ্ট কি না তা জানা যাবে আগামী ২৭ অক্টোবর। বাবুল আক্তারের আইনজীবী চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন দাখিল করেছেন। বাবুল আক্তারের উপস্থিতিতে এ আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
বাবুল আক্তারের আইনজীবী আজমুল হুদা বলেন, ‘আদালত ২৭ অক্টোবর প্রথম মামলাটির চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর আদেশ দেবেন। যদি আদালত আমাদের আবেদন অর্থাৎ নারাজি গ্রহণ না করেন তাহলে বাবুল আক্তারের পরামর্শ সাপেক্ষে আমরা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা চাইবো।’
পিবিআই সূত্রে জানা যায়, মিতু হত্যায় দায়ের হওয়া দ্বিতীয় মামলার আসামি ভোলা ও কয়েকজন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রথম মামলায়ও কয়েকজন আসামি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে উঠে আসে বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় খুন হন মিতু। বাবুলের এই কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেন তার সোর্স হিসেবে পরিচিত কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা। অস্ত্র সরবরাহ করেন এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা। হত্যাকান্ড শেষে বাস্তবায়নকারীদের বাবুল আক্তার তিন লাখ টাকা দেন। মিতুকে হত্যা করতে মুসাসহ অন্যদের অনেকটা বাধ্য করেন বাবুল।
এদিকে, ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ মিতু হত্যাকান্ডে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া মুসা। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হয় বলে অভিযোগ তার পরিবারের। এমনকি তিনি জীবিত নাকি মৃত সে বিষয়েও কোনো তথ্য নেই তদন্ত সংস্থার কাছে। মুসাকে গ্রেফতার করা গেলেই মামলার সমীকরণ পরিবর্তন হবে বলে দাবি পিবিআইয়ের।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে মিতু-বাবুল দম্পতির দুই সন্তান আখতার মাহমুদ মাহির ও তাবাসসুম তাসনিম টাপুরকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত শিশু আইন মেনে মাগুরায় গিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন। কিন্তু তারা মাগুরায় আছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় পিবিআই। তাদের অবস্থান শনাক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদের চেষ্টা চলছে বলে দাবি তদন্ত সংস্থাটির।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়।
ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে তৎকালীন পুলিশ সুপার ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। ওই মামলার প্রায় পাঁচ বছর পর গত ১২ মে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা এ প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এদিকে বাবুল আক্তারের করা মামলায় স্ত্রী হত্যাকান্ডে তারই সম্পৃক্ততা পায় পিবিআই। গত ১২ মে আগের মামলায় চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন।
বাবুল আক্তার ছাড়াও ওই মামলার বাকি সাত আসামি হলেন-মো. কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা (৪০), এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা (৪১), মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম (২৭), মো. আনোয়ার হোসেন (২৮), মো. খায়রুল ইসলাম ওরফে কালু (২৮), সাইদুল ইসলাম সিকদার (৪৫) ও শাহজাহান মিয়া (২৮)।
মামলার এজাহারে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন উল্লেখ করেন, ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বাবুল আক্তার সুদান মিশনে কর্মরত থাকাকালে তার মোবাইল নম্বরে গায়ত্রী ২৯ বার মেসেজ দেন। এই মেসেজগুলো মিতু তার একটি খাতায় নিজ হাতে লিখে রাখেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, মিতু হত্যাকান্ডের সব তথ্য মিলিয়ে দেখার পর প্রতিবেদন দিতে হবে। মামলার এজাহারে থাকা এখনো সব আসামিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। মিতুর সন্তানদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এছাড়া মেলাতে হবে বাবুল ও গায়ত্রীর হাতের লেখা। এসব শেষ হওয়ার পর মামলার তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে চিন্তা করা হবে।
Leave a Reply