এম এল এম কোম্পানী এহসান এর এমডি রাগীব আহসানের বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী হারুনার রশীদের বাড়ী পিরোজপুর সদর উপজেলার মূলগ্রাম রায়েরকাঠী এলাকায়। তিনি তার বাড়ীর অদূরে থাকা তেজদাসকাঠী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক। শিক্ষকতা পেশা থেকে যা আয় করতেন তা দিয়ে ভালই চলছিল তাদের। জমি জিরাত বলতে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিতে একখানা ঘর তার।
হারুন বলেন, এহসানে জড়িয়ে আমি এখন সর্বশান্ত, দিকভ্রান্ত, শুনতে হচ্ছে মানুষের গালমন্দ। তাকে প্রশ্ন করা হয় একজন সচেতন মানুষ হিসেবে কেন এহসানের এ ফাঁদে পড়লেন? এ সময় তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, এহসানে অন্য যারা টাকা রেখেছেন তারা কি অচেতন? হারুনার রশীদের ভাষ্য প্রায় সব পেশার মানুষই এহসানে টাকা রেখেছেন।
এরপর তিনি বলেন, রাগীর একটা যাদুকর। মানুষকে পটানোর ক্ষমতা তার আছে। মাহফিল করে সে মানুষকে পটাতো। তার কথার ফাঁদে পড়ে অনেকের মত আজ আমি সর্বশান্ত। বিদ্যালয় থেকে পাওয়া বেতন থেকে কেটে কুটে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা পাই। এ দিয়ে বর্তমানে চলতে হচ্ছে। বাবা আমার বিনা চিকিৎসায় মারাগেলেন। মা আমার অসুস্থ হয়ে ঘরে শয্যাশায়ী তার চিকিৎসা করানোর সামর্থ আমার নাই, ভালো কিছু খেতেও দিতে পারিনা তাকে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে বালতি আর পাতিল পেতে রাখতে হয় বৃষ্টির পানি ঠেকাতে। মেরামত করার টাকা নাই। সব কিছুই রাগীবের কারনে। পরিবার পরিজন নিয়ে আমি মানবেতর জীবন যাপন করছি, একটা জামা ভিজলে তা শুকিয়ে সকালে গায়ে দিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। রাগীবের কারনে আমার পরিবারের সুখ শান্তি হারিয়েগেছে। এসব কথা বলতে বলতে এক সময় কেদে ফেলেন, হারুনার রশীদ।
তিনি বলেন, আমি মাদ্রাসা থেকে অনার্স মাষ্টার্স করা, কামেল পাশ করা। রাগীব আহসান সম্ভবত ২০০৭ সালের দিকে আমাদের এলাকায় একবার মাহফিল করতে আসে। উদিয়মান একজন বক্তা হিসেবে মাহফিলে তার কথা বার্তা শুনে আমার ভালো লেগেছে। পরে আমি এহসানে জড়াই। হারুনার রশীদ জানান, এহসানে ১২শত মাঠকর্মী আছে। তার পরিচিতি নম্বর ৫। তিনি বলেন,এহসানের সদস্য আছে ১ লাখের উপরে।
মামলার বাদী বলেন, তেজদাসকাঠী বিদ্যালয়ে আমি সিনিয়রিটিতে প্রধান শিক্ষকের পরে। চাকুরী করে যা বেতন পেতাম তা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে ভালই চলছিল। মাঠকর্মীরা কেমন পেতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এম এস এ, কে এস এস, এ এস এস পদ্ধতিতে টাকা রাখা হতো। এম এস এ(মাসিক সঞ্চয় পদ্ধতি প্রতি মাসে সঞ্চয় করার ৭বছরে মেয়াদ শেষে দিগুন টাকা ফেরত পাবে গ্রাহক),কে এস এস(এক কালীন সঞ্চয় পদ্ধতি। গ্রাহক প্রতিমাসে যে টাকা রাখবেন পরবর্তী মাসে সে টাকার মুনাফা পাবেন। এ পদ্ধতি ১০ বছর মেয়াদী) এ এস এস( জমারাখা টাকা সর্বোচ্চ ৫৪ মাস পর ফেরৎ নিতে পারবে)।
হারুন বলেন, এহসানে আমাদের কাজ ছিল কাবিখা পদ্ধতির মত। টাকা সংগ্রহ করে দিতে পারলে কমিশন জুটতো না পারলে না। এরপর তিনি বলেন, আমানতকারী পেত লাখে ২ হাজার বা ১৮শত বা ২ হাজার ৫শত। আর আমরা পেতাম ৬ শত টাকা । আমি মাঠ থেকে প্রায় ২ কোটি তুলে এহসানে দিয়েছি আর আমি দিয়েছি ১৬ লাখ টাকার মত। এহসানে করা আমার ছেলের ডিপিএস এর মেয়াদ পূর্ন ( ১লাখ ২ হাজার) হবার পর তা থেকে ভেঙে ভেঙে ৪০ হাজার টাকার মত আমাকে দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে কুরআনে হাফেজ। এবার সে এস এস সি পরীক্ষা দিবে কিন্তুু তাকে যে ফরম ফিলাপের টাকা দিব তা আমার হাতে নাই। এরপর তিনি বলেন, আমি বিভিন্ন লোকদের কাছ থেকে এহসানে টাকা এনে দেবার পর আমি কৃষি ব্যাংক থেকে ২ লাখ এবং যে ব্যাংকে আমার বেতন যায় সেখান থেকে ৬ লাখ টাকা লোন তুলে লোকদেরকে কিছু কিছু দিয়েছি। যারা না খেয়ে থাকে এরকম লোকদেরকে টাকা দিয়েছি।
প্রসঙ্গত হারুনার রশীদের করা মামলায় এহসান গ্রুপের এমডি মুফতী মাওলানা রাগীব আহসান ও তার তিন ভাই মাওলানা আবুল বাশার, মো. খাইরুল ইসলাম ও মুফতি মাহমুদুল হাসান আদালতের নির্দেশে মঙ্গলবার পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। রিমান্ডে থাকাকালে রাগীব আহসান ও তার ৩ ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে আরো ৪টি প্রতারনার মামলা হয়েছে পিরোজপুৃর সদর থানায়।
এই নিয়ে এহসান গ্রুপের এমডি মুফতী মাওলানা রাগীব আহসান ও তার তিন ভাই এর নামে মোট ৫টি মামলা দায়ের করা হল। মামলার বাদীদের বাড়ী পিরোজপুর সদর ও মঠবাড়িয়ায়। পিরোজপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আ.জ.মো: মাসুদুজ্জামান মিলু বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ওসি জানান, মঙ্গলবার পিরোজপুর সদর উপজেলার কুমারখালী এলাকার মো. হেমায়েত উদ্দিন বাদী হয়ে সদর থানায় ২ কোটি ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগে মামলা দায়ের করেন।
একই দিনে সদর উপজেলার শিকারপুর এলাকার মো. আব্দুল মালেক বাদী হয়ে ২ লাখ ৭৫ হাজার ২০০ টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালী এলাকার মো: মনির বাদী হয়ে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকা আত্মসাৎ ও প্রতারনা মামলা দায়ের করেন। এ ছাড়া একই উপজেলার ছোটশৌলা গ্রামের আবুল হোসেন বাদী হয়ে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ এর মামলা দায়ের করেন।
পিরোজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মোল্ল্যা আজাদ হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় ঢাকার একটি বাসা থেকে এহসান গ্রুপের এমডি মুফতী মাওলানা রাগীব আহসান ও তার ভাই আবুল বাশারকে গ্রেফতার করেছে র্যাব ঢাকা এবং অপর দুই ভাই মুফতী মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও মো. খাইরুল ইসলামকে পিরোজপুরের খলিশাখালীর নিজেদের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পিরোজপুর পুলিশ।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার থেকে তাদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে এসে আমরা মামলার রহস্য উদঘাটন এবং এই বিষয়ে কারা কারা সংশ্লিষ্ট আছেন বা ছিলেন তাদের আমরা তদন্তের মাধ্যমে নিয়ে আসতে সক্ষম হবো। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাক্তি যারা আছেন আশা করছি তারা সুবিচার পাবেন।
Leave a Reply