নদীতে তলিয়ে গেছে হাজারো স্বপ্ন। মৃত্যু হয়েছে হাজারো মানুষের। আত্মার মৃত্যু হয়েছে, মনের মৃত্যু হয়েছে। দেহের মৃত্যুই কি সব? নদীর পারে দাড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যে মানুষটি যার বাড়িঘর সব ছিল কদিন আগে ও গোলা ভরা ধান ছিল। পুরো দস্তুর গৃহস্থ আজ পরিবারের মুখে দুমুঠো অন্ন জোগাড় করতে পারছে না।থাকার জায়গা টুকু পাচ্ছে না। সে কি তার পরিবারের কাছে বেচে আছে? এই মানুষগুলো প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে।
নদী তীরে ভাঙনে আঁকাবাঁকা রেখা সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কম ভেঙেছে, আবার কোথাও বেশি। রাস্তায় রাখা আছে সারি সারি ঘর বাড়ি যারা জায়গার ব্যাবস্থা করতে পেরেছে তারা চলে গেছে আর যাঁরা এখনো কোথাও জায়গার ব্যাবস্থা করতে পারেনাই তাদের ঘরবাড়ি পড়ে আছে। এর মধ্যেই রাত কাটাতে হচ্ছে।
এই দৃশ্যপট রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া পদ্মা ভাঙন এলাকার । ভাঙনে স্থায়ী কোনো প্দক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যুগ যুগ ধরে এ ভাঙন চলমান। প্রতিনিয়ত স্বপ্ন ভাঙছে কূলের মানুষের। নদী ভাঙনের ফলে এখন যেন নতুন করে স্বপ্ন দেখতে-ই ভুলে গেছেন নদীতীরের মানুষ। কোনোমতে জীবন চলছে ঝুপড়ি ঘরে, রাস্তার দ্বারে, অন্যের আশ্রয়ে, নয়তো ভাড়া করা জায়গায়। ভাঙনের কারণে এখানকার শত শত পরিবার এখন বিচ্ছিন্ন নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে।
তাদেরই একজন রুপবান বেগম। বয়স ৩৭। কিছুদিন পত্রিকায় তার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর গোয়ালন্দের কিছু মানবিক মানুষ বিদেশে থাকেন তাদের সংগঠন ” গোয়ালনৃদ প্রবাসী ফোরাম” তার পরিবার কে একটি ঘর প্রদান করেছে। কিন্তু জায়গা না পাওয়ায় এতদিন আটকে ছিল৷ সেই জায়গার ব্যাবস্থাই করা হয়। একটা সময় রহিমাদের সব ছিল। কয়েক দফা নদী ভাঙনের ফলে আজ পরিবারটি নিঃস্ব । রহিমা এখন দুই মেয়ে আর স্বামী নিয়ে পথে বসেছেন।
পদ্মার পাড়ে হাজারে মানুষের বোবা কান্না। সেখানেই এগিয়ে আসেন ফাতেমা স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে তারপরও চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে ভাইয়ের পরিবারে থাকতো। ভাই চার নম্বর ফেরিঘাটের সিদ্দিক কাজির পাড়ার জামে মসজিদে ইমামতি করতো। এইতো কয়েকদিন আগেই মসজিদটি পদ্মার বুকে বিলীন হয়ে যায়। এখন চরম ভোগান্তিতে পড়েছে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা যায় না। লজ্জা সংকোচ, দ্বিধা সব অতিক্রম করে বললো আরতো পারছিনা। আমাকে যদি একটি সেলাই ম্যাশিনের ব্যাবস্থা করতেন এই যাত্রা হয়তো বেচে যেতাম। বাঁচার কি প্রবল আকুতি। আজ কয়েকদিন ভালো মতো খেতে পাইনা।
ফাতেমার মেয়েটি কলেজে পড়ে হয়তো তাকে ঘিরেই তার স্বপ্ন ছিল। বেচে থাকার অবলম্বন ছিল। স্বপ্নগুলো এভাবে সর্বগ্রাসী পদ্মা তার বুকে দাফন করে দিবে সে কথা হয়তো সে কল্পনায় ও ভাবতে পারেনি।
৬২ বছর বয়সি নাসির সরদার। নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন। দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে হিলিতে বাড়ি-ঘর এনে রেখের আশ্রয় নেওয়ার জন্য । এক নদী ভাঙনই তাকে শেষ করে দিয়েছে। নদী ভাঙনে হারিয়েছেন কর্মও। এখন ফাঁকে ফাঁকে নদীতে মাছ ধরতে যান নৌকার কোনো মাঝির সঙ্গে। নদীতে মাছ না মিললে বেলালের চুলোয় আগুন জ্বলে না। এখানে বেলালের গল্পটা আরো নির্মম। কারণ তার স্ত্রী শারীরিক ভাবে অসুস্থ। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
কেমন আছেন জানতে চাইলে বেলাল বলেন, ‘কেমন আর আছি, দেখেন না? কষ্টের কোনো শ্যাষ আছে? নদী ভাঙার পর জীবন কি আর আগের মতো চলে? টাকা-পয়সা থাকলে অন্যের জায়গায় থাকতাম না। টাকা-পয়সা যে কামাই করমু, সে পথও তো নাই। একবার এইটা, আরেকবার ওইটা। এইভাবে আইলাই বিলাই কামে কোনো লাভ আছে? কোনো লাভ নাই। যদি মনে করেন, একাধারে একটা কাম করতাম, তবেই না কিছু টাকা জোগাইতে হাইত্তাম। এখন দ্যাখেনতো, আরেকজনের জায়গাতে থাকি। এটা কেউ ভালোভাবে নেয় না।’
নদী ভাঙার পর মনসুরা বেগম ধার-দেনা করে দুই কড়া জমির ওপর বাড়ি করেছেন। ঘরও এক চালা। দেনার বোঝায় প্রতিদিন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরেন তিনি। খাবারের তালিকায় ভালো কিছু যোগ হয় না তার। কোনোমতে তরিতরকারি দিয়েই দিন চলে। ‘গাঙে ভাঙনের পর থেইকা রত হাত সব ভাইঙা গ্যাছে। অন আর রত চলে না। বেডার কামাই তেমন নাই। চিটাগাং-এ কাম করে। কিন্তু কাল বেডার কামাইও ঠিকমতো পাই না৷ দেনাপাওনার লাইগা মাইনষের কাছে মুখ ছোড়। এই সব আমরা কপালে কইরা নিয়া আইছে। নদী না ভাঙলে এমন হতো না।’—বলেন মনসুরা বেগম।
দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রহমান বাংলা টাইমসকে বলেন, নদী ভাঙনে কবলে পরা মানুষের কষ্ট আর সহ্য হয় না। তিনি মসজিদ ভাঙা নিয়ে আবেগপ্রবন হয়ে পড়েন। নদীভাঙন প্রতিরোধে বড় ধরণের কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন না হবার কারণে এ সব সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। আমরা আমাদের অস্তিত্ব নিয়েও শঙ্কায় আছি।
Leave a Reply