ধরুন আপনি কোনো একটি স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখান থেকে ৬০ মাইল দূরে অবস্থিত কোনো জিনিস কি আপনার দেখতে পাওয়ার কথা? অবশ্যই না। কিন্তু শুনে আশ্চর্য হতে হয় যে, এই ‘বুর্জ খলিফা’ ভবনটি ৬০ মাইল বা ৯৫ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যায়। তাও যেনতেন ভাবে নয়, খালি চোখে একেবারে স্পষ্ট দেখা যায়।
২০১০ সালের ৪ জানুয়ারী আরব আমিরাতের দুবাই শহরে অবস্থিত এই ভবনটি উদ্বোধন করা হয়। নির্মানাধীন সময়ে এই ভবনটিকে সবাই ‘বুর্জ দুবাই’ নামে চিনলেও উদ্বোধনের সময় নাম পরিবর্তন করে রাখা ‘বুর্জ খলিফা’। এই ভবনটির আরেক নাম ‘দুবাই টাওয়ার’।
‘বুর্জ খলিফা’ আরবি শব্দ, এর বাংলা অর্থ ‘খলিফার টাওয়ার’। দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম ভবনটির উদ্বোধন করেন। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সম্মানে ভবনটির নামকরণ করেন বুর্জ খলিফা।
বিশ্বের সর্বোচ্চ এই ভবনটি তৈরি করতে যে পরিমাণ গ্লাস ও স্টিল ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো একসাথে রাখতে ১৭টি স্টেডিয়ামের সমান জায়গা প্রয়োজন হবে। ভবনটি তৈরি করতে যে পরিমাণ ইট-বালি-সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে তা দিয়ে ১২৮৩ মাইল লম্বা দেওয়াল তৈরি করা যাবে। আশ্চর্যের এখানেই শেষ নয়। এবার আসুন ভবনটি সম্পর্কে সাধারণ কিছু তথ্য জেনে নিই।
গঠনগত বৈশিষ্ট্য : রকেটের মতো দেখতে ১৬০ তলাবিশিষ্ট ‘বুর্জ খলিফা’র মোট উচ্চতা ২ হাজার ৭১৭ ফুট। ছয় লাখ বর্গফুটবিশিষ্ট এই ভবনে একসঙ্গে ১২ হাজারেরও বেশি লোকের সমাবেশ হতে পারে। বুর্জ ভবনে ৫৪টি এলিভেটর বা লিফট আছে। এগুলোর গতি ঘণ্টায় ৪০ মাইল।
বুর্জ খলিফার মোট তলার সংখ্যা : ‘বুর্জ খলিফার’ মোট তলা কতটি তা নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মত। যেমন – কোথাও আছে ‘বুর্জ খলিফা’র মোট তলা ১৬৯, আবার কোথাও ১৬৫, কোথাও বা ১৬৩। তবে উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায় ‘বুর্জ খলিফা’র মোট তলার সংখ্যা ১৬০টি। ঘুরেফিরে সব জায়গাতে ১৬০ থেকে ১৬৯ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে সম্পূর্ণ বুর্জ খলিফার মোট তলার সংখ্যা ২০৬। এর মধ্যে ১৬০ তলা পর্যন্ত রয়েছে বিভিন্ন অফিস, আবাসন, মসজিদ, সুইমিংপুল সহ বিভিন্ন জিনিস। আর ১৬০ তলার পর থেকে ২০৬ তলা পর্যন্ত ভবনটি পরিচালনায় সহায়ক বিভিন্ন কারিগরি কাজে ব্যবহৃত হয়।
এরমধ্যে ১৬০টি বাস যোগ্য, ৪৬টি কারিগরির জন্য, নিচে ২টি গাড়ী পার্কিংয়ের জন্য।
ভবনটি তৈরিতে খরচ : সম্পূর্ণ ভবনটি তৈরি করতে মোট ব্যয় হয় ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় এর পরিমাণ এগার হাজার ছয়শত সত্তর কোটি টাকা।
‘বুর্জ খলিফা’র বাইরের প্রাঙ্গনে দৃষ্টিনন্দন একটি ফোয়ারা রয়েছে। এই ফোয়ারটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে ১৩৩ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ দাড়ায় এক হাজার ছয়শত একানব্বই কোটি আটত্রিশ লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার।
নির্মাণগত কিছু তথ্য : বিস্ময়কর এই ভবনের অবস্থান দোহা স্ট্রিট, শেখ জায়েদ সড়ক, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই স্থাপনার স্থপতি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অড্রিয়ান স্মিথ।
‘বুর্জ খলিফা’ ভবনটি তৈরি করতে এমনও দিন ছিলো যেদিন একসাথে ১২ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। সে সময় প্রতি তিন দিন পরপর এক একটি ছাদ ঢালাই দেয়া হতো। দুবাইতে প্রচন্ড গরমের কারণে দিনের বেলা ছাদ ঢালাই দেয়া যেতো না। কারণ গরমে কংক্রিট জমাট বাঁধতে পারতো না। এজন্য রাতের বেলা ছাদ ঢালাই দেয়া হতো যাতে বাতাসের সংস্পর্শে কংক্রীট সহজেই জমে যেতে পারে। অনেক সময় কংক্রীটের সাথে বরফও ব্যবহার করা হয়েছে।
বুর্জ আল খলিফার নির্মাণকাজ শুরু হয় ২১ সেপ্টেম্বর ২০০৪ এবং কাজ শেষ হয় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে। ৪, জানুয়ারি, ২০১০ তারিখে আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্ভোধন করা হয়।
জানুয়ারী ২০০৪ এ ভিত্তি স্থাপন করা হয়। ফেব্রুয়ারী ২০০৪ এ পাইলিং বা কলাম এর কাজ শুরু হয়। সেপ্টেম্বর ২১, ২০০৪ ইমার কনস্ট্রাকটরস (Emaar contractors) নির্মাণ কাজ শুরু করেন। মার্চ ২০০৫ এ ‘বুর্জ খলিফা’ ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে থাকে। জুন ২০০৫ এ ‘বুর্জ খলিফার’ নির্মাণ কাজ ৫০ তলায় গিয়ে পৌঁছায়। ফেব্রুয়ারী ২০০৭ এ ‘বুর্জ খলিফা’ বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে রেকর্ড বুকে অধিষ্ঠিত হয়। জুলাই ২১, ২০০৭ এ ‘বুর্জ খলিফার’ নির্মাণকাজ ১৪১ তলায় গিয়ে পৌঁছে। সেপ্টেম্বর ১২, ২০০৭ এ ‘বুর্জ খলিফার’ নির্মাণকাজ ১৫০ তলায় গিয়ে পৌঁছে। এপ্রিল ৭, ২০০৮ এ ‘বুর্জ খলিফার’ নির্মাণকাজ ১৬০ তলায় গিয়ে পৌঁছে। অক্টোবর ১, ২০০৯ সালে এমার কনস্ট্রাকশন ‘বুর্জ খলিফা’র নির্মাণ কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করে।
চলুন ভেতর থেকে একটু ঘুরে আসি : স্বশরীরে ভবনের ভেতরে যেতে হলে খরচ করতে হবে পকেটের টাকা। ১৬০ তলা ভবনের মধ্যে প্রায় একশ’ তলায় যেতে টিকেট নেয় ২শ’ দিরহাম, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা। আর ১৬০ তলায় যেতে হলে অনুমতি নিয়ে আরও অনেক বেশি দিরহাম গুনতে হয়।
বুর্জ খলিফার ১৬৯ তলায় যেতে হলে সাথে করে অক্সিজেন নিয়ে যেতে হয়। বুর্জ খলিফায় ১৬৯ তলার ওপর থেকে মাঝামাঝি স্থানে দিনে-রাতে চব্বিশ ঘণ্টায় জোনাকির মতো একবার সাদা আলো জ্বলছে আবার আলো নিভছে; যা বহুদূর থেকে দেখা যায়।
বুর্জ খলিফার অধিবাসীরা অন্যদের চেয়ে আগে সূর্য দেখেন : বুর্জ খলিফায় বসবাসরত অধিবাসীরা দিনের শুরুতে সমতলের অধিবাসীদের চেয়ে আগে সূর্য দেখেন এবং দিনের শেষেও সমতলের অধিবাসীদের চেয়ে তারা বেশি সময় সূর্য দেখতে পান। এ জন্য তাদের কাছে দিনের পরিধি অনেক বেশি। ফলে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ্যবর্তী সময়ের বিস্তার অনেক বেশি।
বুর্জ খলিফার ওজন : বিশ্বের সর্বোচ্চ এই ভবনটির মোট ওজন ৫ লাখ টন। ভবনটি নির্মাণে লেগেছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কিউবিক মিটার কংক্রিট, ৩৯ হাজার মিটার স্টিল, ১ লাখ ৩ হাজার বর্গমিটার কাচ এবং ১ লাখ ৫৫ হাজার বর্গমিটার স্টেইনলেস স্টিল।
প্রতি বর্গ মিটার জায়গার দাম : বিলাস বহুল এই ভবনের একেকটি কামরা কেনার জন্য বর্গ মিটার প্রতি ক্রেতাদের গুনতে হয়েছে গড়ে ৩৭,৫০০ মার্কিন ডলার। এত উচ্চ মূল্য থাকা স্বত্বেও দুই বছরের মধ্যেই ৯০০ কামরার প্রায় সবকটিই বিক্রি হয়ে গেছে। বুর্জ খলিফায় প্রতি বর্গফুট জায়গার মাসিক ভাড়া (অফিস-আদালতের জন্য) চার হাজার ডলার বা দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা।
ভবনের বাইরে দৃষ্টিনন্দন বিশাল পার্ক : ভবনটির চারপাশে রয়েছে ৭.৪ একরের অপরুপ সুন্দর উদ্যান আর ৩০ একর আয়তনের কৃত্রিম হ্রদ। বুর্জ খলিফার বাসিন্দাদের জন্য প্রতিদিন ৯,৪৬,০০ লিটার পানির প্রয়োজন পড়ে যা ১০০ কিমি. পরিমান অভ্যন্তরীণ পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। শীততাপ নিয়ন্ত্রনের জন্য ৩৪ কিমি. এবং জরুরি অগ্নি নিয়ন্ত্রনের জন্য রয়েছে আরও ২১৩ কিমি. পরিমান বিশেষ পাইপ লাইন ব্যবস্থা। বিশাল এই ইমারতটি একসঙ্গে ২৫ হাজার লোকের ভার সইতে পারবে।
আমেরিকানদের অগ্রাধিকার : বুর্জ খলিফায় আমেরিকানদের বসবাসের অগ্রাধিকার বিশেষভাবে লক্ষনীয়। তাদের জন্য এই ভবনের ৯ থেকে ১৬ তলা পর্যন্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
আত্মহত্যায় রেকর্ড : কত ধরনের রেকর্ডই তো রয়েছে এই পৃথিবীতে। তেমনি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবনের রেকর্ডের পাশাপাশি ‘বুর্জ খলিফা’র রয়েছে আত্মহত্যায়ও রেকর্ড। ভবনটি চালু হওয়ার ১৮ মাস পর ১০ মে ২০১১ তারিখ জনৈক ব্যক্তি এই অট্টালিকার ১৪৬ তলা থেকে লাফিয়ে পড়েন। লাফিয়ে পড়ার পর লোকটি ৩৮ তলায় এসে পড়ে নিহত হন। এটিই হচ্ছে সবচেয়ে উঁচু স্থান থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করার রেকর্ড।
মালিকানা: বুর্জ খলিফার মালিকানা দুবাইয়ের একটি আধা সরকারি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এমার প্রপার্টিজ। এর স্থপতি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের অড্রিয়ান স্মিথ। এর নকশা প্রণয়নকারী হলো যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্কিডমোর ওয়িংস অ্যান্ড মেরিল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং, বেলজিয়ামের বিইএসআই এক্স গ্রুপ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের আর্বটেক। প্রায় দুই কোটি ২০ লাখ শ্রম ঘণ্টা লেগেছে ভবনটি নির্মাণে। এ প্রকল্পে জড়িত ছিলেন ৩৮০ জন দক্ষ প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ।
বাইরের জানালা পরিষ্কার: বুর্জ খলিফায় রয়েছে ২৪,৩৪৮টি জানালা। এসব জানালা কিভাবে পরিষ্কার করা হবে তার পরিকল্পনা নির্মাণ করার সময়ই করা হয়। জানালা পরিষ্কার করার জন্য অনুভূমিকভাবে (হরিজেন্টালি) ৩টি ট্রাক রয়েছে। এই ট্রাকগুলো ৪০, ৭৩ ও ১০৯ তলায় অবস্থিত। পরিচ্ছন্নকর্মীরা উপরের ট্রাক থেকে পরিষ্কার করতে করতে নিচের ট্রাকে এসে থামে। বুর্জ খলিফার বাইরের সম্পূর্ণ অংশ এভাবে পরিষ্কার করতে ৩৬ জন শ্রমিকের ৩ থেকে ৪ মাস সময় লেগে যায়।
যাদের শ্রমে নির্মিত হয়েছিল বিশাল এই ভবনটি : টাওয়ারটি নির্মাণে শ্রমিক আনা হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়া থেকে। অভিযোগ আছে, সেসব শ্রমিকদের পারিশ্রমিক ঠিকমতো দেওয়া হয়নি। মাঝে একবার শ্রমিকদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল দেশটির সরকারকে। একজন দক্ষ কাঠমিস্ত্রি রোজ ৪ দশমিক ৩৪ পাউন্ড করে পেতেন। আর সাধারণ শ্রমিকদের দেওয়া হতো দৈনিক ২ দশমিক ৮৪ পাউন্ড করে। এই যতসামান্য পারিশ্রমিকও প্রায়ই আটকে দেওয়া হতো। এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়েই আড়াই হাজার শ্রমিক ২০০৬ সালের ২১ মার্চ কর্মবিরতি ঘোষণা এবং বিক্ষোভ করেন।
ভূমিকম্প প্রতিরোধী : খারাপ আবহাওয়ায় যাতে ভেঙে না পড়ে বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য ভবনটি ওয়াই আকৃতিতে তৈরি করা হয়েছে। এর ওজন সমভাবে বহন নিশ্চিত করতে তিনটি উইং রয়েছে।
ফ্লোর বিন্যাস: ভবনের ১৯ থেকে ৩৭ তলা এবং ৭৭ থেকে ১০৮ তলায় থাকার ব্যবস্থা আছে। প্রায় ৯০০ অ্যাপার্টমেন্ট আছে ভবনে। ১৫৮তলায় আছে একটি মসজিদ; ৪৩তম এবং ৭৬তম তলায় আছে দুটি সুইমিং পুল। আরো আছে ১৬০ কক্ষবিশিষ্ট একটি হোটেল। ১২৪তম তলায় দর্শকদের জন্য প্রকৃতি দর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিস্তারিত দেখে নিই নিচের টেবিল থেকে।
২০১৬ সালের মধ্যেই ‘বুর্জ খলিফার’ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটটি নিজের করে নিবে সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে নতুন নির্মাণাধীন একটি ভবন। সৌদি যুবরাজ আল ওয়ালিদ বিন তালাল জেদ্দা শহরে লাল সাগরের পারে এই ভবনটি তৈরি করছেন। এই ভবনটির উচ্চতা হবে ১০০০ মিটার। যুবরাজের এই স্বপ্নের বাড়িটিতে থাকবে হোটেল, বিলাসবহুল বাসস্থান, সবরকমের সুযোগ, সুবিধা সম্পন্ন অফিস। বিন লাদেন গোষ্ঠীর সঙ্গে ৪.৬ বিলিয়ন রিয়াল বা ৭৫ কোটি ৬০ লক্ষ পাউন্ডের চুক্তি করা হয়েছে এই ভবনটি নির্মাণের জন্য। ২০১১ সালের আগস্ট মাসে এই চুক্তি হয় এবং পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে এই ভবনের নির্মাণ শেষ হবে।
তথ্যসূত্র : সংগৃহিত
Leave a Reply