1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : Editor :
এক যুগ ধরে বাঁধা দুটি জীবন - বাংলা টাইমস
বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩, ০৯:৪৪ পূর্বাহ্ন

এক যুগ ধরে বাঁধা দুটি জীবন

সুজন কুমার মন্ডল, জয়পুরহাট
  • প্রকাশের সময় : রবিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১
  • ১৬১ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে

জয়পুরহাটে এক যুগ ধরে বাঁধা দুটি জীবন। দুটি পায়ে পরানো হয়েছে লোহার চাকতি লাগানো শিকল ও বাইসাইকেলের চেইন। আর সেই শিকলে ও চেইনে লাগানো হয়েছে বড় তালা। দিনে বাড়ির উঠানের কাঁঠাল গাছের সঙ্গে আর রাতে ঘরে চৌকির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয় তাদের।

 

আর এভাবেই অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে প্রিয় দুই সন্তানকে প্রায় এক যুগ ধরে লোহার শিকল ও চেইন লাগিয়ে বেঁধে রাখেন জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নের বিয়ালা গ্রামের আতার পাড়া সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা হত দরিদ্র মা রওশন আরা।

 

দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত এই পরিবারটি তিন বেলা যেখানে আহার জোটাতেই অক্ষম, সেখানে সন্তানদের চিকিৎসা করাবেন কিভাবে। মেয়ে আম্বিয়া বেগম(২৬) ও ছেলে রোস্তম আলী (২৪) প্রায় এক যুগ ধরে তারা দুজনেই মানসিক ভারসাম্যহীন।

 

তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মনে করেন উন্নত পরিবেশে দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা সেবা দেওয়া হলে আবার ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের।

 

জানা গেছে, এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ও রওশন আরা দম্পত্তির মানসিক ভারসাম্যহীন বড় মেয়ে মোছা. আম্বিয়া বেগম ও মেঝ ছেলে মো. রোস্তম আলী। উপজেলা সদর থেকে আকা-বাকা রাস্তা রাস্তা দিয়ে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙ্গা টিনের বেড়া এবং টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরে শিকলবন্দী অবস্থায় দু-ধারে বসে আছেন আম্বিয়া ও রোস্তম আলী।

 

সেই ঘরে আছে একটি চৌকি, একটি চেয়ার ও একটি টেবিল। চৌকির ওপর ছেঁড়া ও আধা ভেজা কাঁথায় দু-ধারে জড়সড় হয়ে বসে ছিলেন তারা দু ভাইবোন। ঘরে কেউ ঢুকলেই তার নাকে আসবে দুর্গন্ধ। তাদের প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হয় ঘরের পাশেই। চেয়ারে রাখা ছেঁড়া ও ময়লা কাঁথা দুর্গন্ধে ভরা।

 

প্রায় ১০ ফুটের শিকলে এক যুগ ধরে এভাবেই বাঁধা দুজন। সেখানে তাদেরকে কেউ খাবার খাইয়ে দিলে তাদের ক্ষুধা মেটে, নতুবা থাকতে হয় উপোস।

 

সেখানে কথা হলো আম্বিয়া ও রোস্তমের মা রওশন আরার সঙ্গে। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, আমার স্বামী রফিকুল ইসলাম দিন মজুরের কাজ করে। আর আমি গৃহিনী। তবে সংসারের অর্থ স্বচ্ছতার জন্য অন্যের বাড়িতে মাঝে মধ্যে কাজ করি। প্রায় ২৮ বছর আগে আমাদের বিবাহ হয়। এরই মধ্যে আমাদের সংসারে ছেলে-মেয়ে জন্ম হয়। আমার বড় মেয়ে মোছা. আম্বিয়া বেগম যখন ১২ বছরের কিশোরী, ঠিক তখনই দেখা যায় তার আচরণে অস্বাভাবিকতা। সে সময় স্থানীয় কবিরাজের পরামর্শে কিশোরী আম্বিয়াকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের দিনমজুর মনোয়ারের সঙ্গে বিয়ে দেই।

 

কিন্তু বিধি বাম। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে তার আচরণগত সমস্যা আর ও বেশি খারাপ হতে থাকে। এ অবস্থায় তাকে বগুড়া, পাবনা ও রংপুরে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু তার দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা করা সম্ভব হয় নি। এর মধ্যে আমাদের সংসারে একমাত্র ছেলে রোস্তম ও ১২ বছর বয়সে অন্য ১০ জন ছেলের তুলনায় ভিন্ন রকম আচরণ শুরু করে। এই দেখে তাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলেও টাকা-পয়সার অভাবে তার ও চিকিৎসা বন্ধ করতে হয়েছে।

 

পরে সে স্থানীয় বাসিন্দাসহ বিভিন্ন প্রাণীকে মারধর করতে শুরু করে। আমার ঘরের জিনিসপত্র ভাঙ্গচুর করা সহ পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের কাছে পেলেই তাদের মারধর শুরু করে। অনেক সময় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে তারা আর সময় মতো বাড়িতে ফিরে আসে না। আমার দুই সন্তান যেন আমাদেরকে ছেড়ে দূরে কোথাও না যায়, সেই আতঙ্কেই পায়ে শিকল লাগিয়ে তাদেরকে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছি। এসব দুশ্চিন্তার কারণে বর্তমানে তাদের বাবা রফিকুল ইসলাম ও প্রায় পাগল। আমার সংসারে এতো অশান্তি থাকায় আমি কি করবো তা আমার মাথায় কোন কাজ করছেনা। এই বলে তিনি হাও মাও করে কেঁদে উঠলেন।

 

প্রতিবেশী ইয়াকুব আলী (৫১) বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন আম্বিয়া বেগম ও রোস্তম আলীসহ মা-বাবা একসঙ্গে থাকেন। তারা খুব অসহায়। অর্থের অভাবে তারা চিকিৎসা করতে পারছেন না। তবে সুচিকিৎসা করাতে পারলে তারা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।

 

আরেক প্রতিবেশী কুলসুম বেগম (৪৫) বলেন, তাদের পরিবারের প্রায় সবাই এখন পাগল। শুধু তাদের মা তাদের দেখভাল করে। অভাবের কারণে তারা ঠিকমতো খেতেও পারেন না। অনেক সময় তাদেরকে ছেড়ে দিলে কোথাও গেলে আর বাড়ি ফিরে আসতে চায়না। তাই তাদের পায়ে শিকল দিয়ে গাছে বেঁধে রাখতে হয়।

 

কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আ.ন.ম. শওকত হাবিব তালুকদার লজিক বলেন, তাদেরকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ওই দুই ছেলে-মেয়েকে সুচিকিৎসার জন্য সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে সার্বিক চেষ্টা করা হচ্ছে।

 

কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শাহিন রেজা বলেন, আমার জানামতে আম্বিয়া বেগম ও রোস্তম আলীকে উন্নত পরিবেশে রেখে দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা সেবা দেওয়া হলে আবার ও তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

কালাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্মকর্তা টুকটুক তালুকদার বলেন, খবর পেয়ে আমি নিজেই ওই দুই ভাই-বোনের বাসায় গিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছি এবং তাদের পরিবারের হাতে কিছু নগদ অর্থও দেওয়া হয়েছে। তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তির বিষয়ে তাদের কিছু কাগজপত্র প্রয়োজন আছে। তার পরিবারকে খুব দ্রুতত সেই কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে। জমা দিলেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হবে।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published.

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায় সিসা হোস্ট